পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর আসন্ন। এদিকে লিবিয়ায় অপহরণের শিকার ৪জন শ্রমিকের পরিবারে চলছে কান্নাকাটি। তাঁরা দেশের উত্তরের জেলা লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের পাশাপাশি চার গ্রামের বাসিন্দা। ধার-দেনা করে, জমি বন্ধক বা বিক্রি করে ৩বছর আগে লিবিয়ায় যাওয়া এসব শ্রমিকের দরিদ্র পরিবারের পক্ষে অপহরণকারীদের দাবি করা মুক্তিপণের টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। আবার মুক্তিপণের টাকা বাংলাদেশে থাকা অপহরণকারী চক্রের বিকাশ নম্বরে পর্যায়ক্রমে না দিলে ওই ৪জন শ্রমিককে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
অপহরণের শিকার ওই ৪জন শ্রমিক হলেন- লালমনিরহাট সদর উপজেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের সিন্দুরিয়া গ্রামের জয়নাল আবেদিনের পুত্র আল আমিন (২৩), জয়নাল আবেদিনের জামাতা ও পার্শ্ববর্তী কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙার ইদ্রিস আলীর ছেলে হাফিজুল ইসলাম (৪০), রাজারহাটের ভীম শর্মা গ্রামের আবদুল মোতালেবের ছেলে আল আমিন (২২) এবং তাঁর খালাতো ভাই ও পঞ্চগ্রামের রামরাম গ্রামের শাহিনুর ইসলামের ছেলে রাকিবুল ইসলাম (২৪)। তাঁরা লিবিয়ার বেনগাজিতে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন।
লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের সিন্দুরিয়া গ্রামে দরিদ্র কৃষক জয়নাল আবেদিন (৬০) এর বাড়িতে রয়েছে তাঁর ভাঙাচোরা চারচালা টিনের ঘর। ৩বছর আগে জমিজমা বিক্রি করে ৫লক্ষ টাকা খরচ করে একমাত্র ছেলে আল আমিনকে লিবিয়ায় পাঠান। ছেলের সঙ্গে তাঁর জামাতা হাফিজুল ইসলামও লিবিয়ায় যান।
জয়নাল আবেদিন বলেন, ৩বছরে কোনো সমস্যা না হলেও চলতি বছরের ১১ মার্চ সকাল ৮টায় অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি তাঁর ইমো নম্বরে ফোন করেন। এ সময় জানানো হয়, তাঁর ছেলে আল আমিন ও জামাতা হাফিজুল ইসলামকে অপহরণ করা হয়েছে। মুক্তির জন্য ১লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দিতে হবে। তা না হলে তাঁদের ২জনকে হত্যা করা হবে মর্মে হুমকি দেওয়া হয়।
জয়নাল আবেদিন বলেন, অজ্ঞাতনামা ওই ব্যক্তি ২টি বিকাশ নম্বরে ৫০হাজার করে মোট ১লক্ষ টাকা পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন।
ছেলে ও জামাতা অপহরণের শিকার হওয়ার কথা জানার পর থেকে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন জয়নাল আবেদিনের স্ত্রী আলেয়া বেগম। দিন-রাত শুধু কান্নাকাটি আর দোয়া-দরুদ পাঠ করছেন।
আলেয়া বেগম বলেন, তাঁর ছেলে ও জামাতা গ্রামের আবদুল মোন্নাফের ছেলে লিবিয়াপ্রবাসী মিজানুর রহমানের মাধ্যমে লিবিয়ায় গেছেন। এই অপহরণের সঙ্গে মিজানুর জড়িত আছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। মিজানুরের লোকেরা মুক্তিপণের জন্য নগদ টাকার লোভে তাঁর ছেলে ও মেয়ের জামাইকে লিবিয়ায় অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখে তাঁর লোকদের দিয়ে মুক্তিপণের টাকা চাচ্ছেন।
আলেয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ছেলে আর মেয়ের জামাই ঠিকমতো টাকা-পয়সা কামাই করতে পারে নাই। এখন এই টাকা কোথ থেকি জোগাড় হইবে? টাকা না দিলে ওরা তো ওদের মারি লাশও গুম করি দিবে…।
স্বামী অপহরণের শিকার হওয়ার পর থেকে জয়নাল আবেদিনের মেয়ে জয়নব বেগম (৩৫) বাবার বাড়িতে আছেন। পাশের রাজারহাটের ঘড়িয়ালডাঙায় তাঁর শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুরবাড়ি থেকে তাঁকে বলা হয়েছে, স্বামীকে অপহরণকারীদের কাছ থেকে ছাড়াতে না পারলে যেন স্বামীর বাড়িতে না ফেরেন।
জয়নব বলেন, আমার স্বামী আমার একমাত্র ভাই আল আমিনের সঙ্গে লিবিয়ায় গেইছে। এখন সেখানে অপহরণের শিকার হওয়ায় আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন স্বামীকে খুঁজে বের করে দেশে আনার পর বাড়িত যাবার কইছে।
তিনি বলেন, আমার ২টা মেয়ে, আমার সংসার বোধ হয় নষ্ট হয়া গেল। আমাদের ঈদের আনন্দ নাই। ভাই আর স্বামীক ফিরি পাইলে শান্তি পাইতাম।
পঞ্চগ্রামের পাশেই রাজারহাটের ভীম শর্মা গ্রাম। এই গ্রামের আরেক আল আমিন দুই বছর আগে লিবিয়ায় কাজে যান। আল আমিনের বড় ভাই লিটন মিয়া (২৩) বলেন, গত ১১ মার্চ সকাল আনুমানিক ৭টা ৫১মিনিটে লিবিয়া থেকে আমার নম্বরে ফোন করে জানানো হয় যে আমার ভাই আল আমিন, খালাতো ভাই রাকিবুল, সিন্দুরিয়া গ্রামের আরেক আল আমিন, তাঁর ভগ্নিপতি হাফিজুলকে অপহরণ করা হয়েছে। তাঁদেরকে জীবিত দেখতে চাইলে জনপ্রতি ৫লক্ষ টাকা করে মুক্তিপণ দিতে হবে। আইনের আশ্রয় নেওয়া হলে তাঁদের হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলার হুমকি দেয়।
লিটন মিয়াও অভিযোগ করেন, এর পেছনে পঞ্চগ্রামের সিন্দুরিয়া গ্রামের আবদুল মোন্নাফের লিবিয়াপ্রবাসী ছেলে মিজানুর রহমান, একই ইউনিয়নের রামরাম গ্রামের সামসুল হকের ছেলে লিবিয়াপ্রবাসী মোঃ নাজমুল হুদা (২৩) এবং একই গ্রামের আবু বক্কর সিদ্দিকের ছেলে লিবিয়াপ্রবাসী মোঃ সুলতান (৩২) কোনো না কোনোভাবে জড়িত রয়েছেন। আমি লালমনিরহাট সদর থানায় মামলা করবো।
জয়নাল আবেদিনও থানায় লিখিত অভিযোগ দেবেন বলে জানান। এদিকে অভিযোগের ব্যাপারে কথা বলে পঞ্চগ্রামের সিন্দুরিয়া গ্রামের মৃত কাশেম আলীর ছেলে আবদুল মোন্নাফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তাঁর লিবিয়াপ্রবাসী ছেলে মিজানুর রহমান একজন সৎ ও পরিশ্রমী যুবক। তাঁদের আর্থিক উন্নতির কারণে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁরা এসব মিথ্যা কথা বলছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিনিও শুনেছেন, গ্রামের কয়েকজন লিবিয়ায় অপহরণের শিকার হয়েছেন।
লালমনিরহাট সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোঃ রুহুল আমিন বলেন, লিবিয়ায় মুক্তিপণের জন্য শ্রমিকদের অপহরণের বিষয়ে ২টি পৃথক লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগের বিষয়টি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অবহিত আছেন। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ওসি স্যারের নির্দেশনার আলোকে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।